ফ্রেন্ডশিপ (ফল ইন ডেস্পারেট অন বিলিভ)
খালিদ বিন মাসুদ
এক. (যাত্রী ছাউনিটার পাশে)
ভাদ্র মাসের প্রচন্ড রোদে হেলমেট পরে আর এক মুহূর্তও বাইক চালাতে ইচ্ছে করছে না। পথ যেনো শেষই হচ্ছে না! অথচ অন্য সময় শতকিলো বাইক চালাতে আগ্রহের কমতি থাকে না ভিকির। বাইক চালাতে চালাতে ভিকি এক সময় আপন মনে গুনগুন করে বলে উঠলো - আর কতো সময় লাগবে ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছাতে? যদিও অন্য দিনের তুলনায় আজকের দিনটা ভিকির জন্য কিছুটা স্পেশালও বটে। তাছাড়া ছোট ভাই শিহাবের সাহসের উপর ভর করে বেশ কিছুটা আগবাড়িয়েই এই পথ চলা।
অল্প সময় কল্পনায় চলে গেলেও সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো ক্যান্টনমেন্ট। ভিকি পিকাপ বাড়িয়ে এগিয়ে চললো।
যাত্রী ছাউনিটার পাশে এসে বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলে এক গভীর শ্বাস ছেড়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বেঞ্চে বসে টিস্যু দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে ভিকি লক্ষ্য করলো বেঞ্চের অন্য কোনে একটি মেয়ে বোরকা পরে বসে আছে। ভিকি একবার মেয়েটিকে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগলো লতা মঙ্গসকারের গান - বাহার ছে কই আন্দার আ না ছাকে, আন্দার ছে কই বাহার যা না ছাকে, ছোচো কাভি এইছা হো তো কিয়া হো, হাম তুম এক কামরে মে বান্দ হো...
দেখতে দেখতে মিনিট পাঁচেক সময় পার হয়ে গেলো, ভিকি এবার একটু অস্থির হয়ে পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করতে গিয়ে মনে পড়লো সে তো ফোনটি বাসায় চার্জে রেখে এসেছে! এখন উপায়! এবার ভিকি একটু কেষে বেঞ্চের কোনের মেয়েটিকে বললো - এক্সকিউজ মি, ম্যাম, হাভ ইউ ফোন? মেয়েটি নির্পলক ভিকির দিকে তাকিয়ে রইলো। ভিকি এবার গলা মোটা করে বললো - আসোলে আমার ফোনটা ভুল করে বাসায় রেখে এসেছি। কথা শেষ হবার আগেই মেয়েটি ব্যাগ থেকে নীল রঙের একটি বাটন ফোন বের করে হাত বাড়িয়ে দিলো। ফোনটি ছো মেরে তুলে নিয়ে ভিকি একমনে নাম্বার ডায়াল করে চললো।
কিছু সময় পর ওপাশে ছোট ভাই শিহাব বলে উঠলো - কে? ভিকি - আমি ভিকি। শিহাব - এএ কোন ভিকি? ভিকি (একটু আস্তে)- আরে বড় ভাই ভিকি! শিহাব - ও ভাই (হাসতে হাসতে), তা বলেন কতদূর কি হলো? ভিকি - আরে কি বলবো আর, ফোন তো বাসায় রেখে আসছি। শিহাব - বলেন কি ভাই! ভিকি - সেই তো, আর এখানে এক মেয়ের কাছ থেকে ফোন ধার নিয়ে তোমারে ফোন দিলাম। শিহাব (হেসে কুটিকুটি) - ডেট করতে এসে এক মেয়ের ফোন ধার নিয়ে অন্য মেয়েকে ফোন দেবেন! ভাই আপনিই পারবেন। প্রভু তু সি গ্রেট হো, তওফা কবুল কারো... শিহাব ফোনটি কেটে দিলো। ভিকি কয়েকবার হ্যালো বলে ড্যাম ইট বলে মোবাইলটা মাথায় টোকাতে লাগলো। এতোক্ষণে মেয়েটি ভিকির পাশে এসে বসে মুখের নেকাপ খুলে কানে পিন গুজে ভিকির দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে শুরু করেছে। ভিকি কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেয়েটি বলে উঠলো - তো কেমন আছেন? ভিকি - এই তো আছি। মেয়েটি - তো এখানেই বসে থাকবেন না চা কফি কিছু খাবেন? ভিকি - শিওর, চলুন ঐ কফি শপে। বলেই ভিকি উঠে হাটতে শুরু করলো। মেয়েটিও ভিকির পিছে এগিয়ে চললো। ভিকি মনে মনে ভাবতে লাগলো - এই কি সেই মেয়ে, যার সাথে আমার দেখা হবার কথা আছে!
দুই. (ডন রেজোর অফিস)
মৃদুস্বরে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো নাঈম। নাঈম - ডন রেজো, মিশন ফেইল! ডাঃ নাদি সুইসাইড করেছে। ডন রেজো (ভারী কন্ঠে) - আমি শুনছি। নাঈম - সুইসাইড নোট পুলিশের হাতে পড়েছে সম্ভবত , তবে আমি ওটা ম্যানেজ করে ফেলেছি প্রায়। ডন রেজো (ভারী কন্ঠে) - পুলিশের হাতে যাবার আগেই আমি চাই সেটা, সামনে যেই আসুক দেখার দরকার নেই। নাঈম জ্বী বলে মাজার পেছন থেকে পিস্তল বের করে পুনরায় লোড করে ডন রেজোর অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
তিন. (কফি হাউজের আড্ডা)
ভিকি - আচ্ছা আপনি করেন কি? মেয়েটি - লেখাপড়া। ভিকি - কোথায়? মেয়েটি - আপাতত বাসায় আছি। ভিকি - কেনো? মেয়েটি (একটু উদাস হয়ে) - আসলে আমার মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে। মামারা মাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিছে। আমার স্থান কোথাও হয় নি (কেদে দিয়ে)। আমি আমার আন্টির কাছেই আছি। ভিকি একটু থমকে গেলো। মেয়েটি (মুচকি হেসে) - জানেন আমি আমার আন্টির শরীর থেকে মায়ের গন্ধ পাই। ভিকি - অপস, সরি। মেয়েটি - সরির কিছু নেই, আপনার বিষয় বলেন শুনি। ভিকি - এই তো কাজ করি, খাই দাই, ঘুরি ফিরি। মেয়েটি (কফিতে চুমুক দিয়ে) - আচ্ছা আপনার ফ্যামিলির কথা বলেন। ভিকি - উম ফ্যামিলিতে আছে সবাই, কিন্তু কিছু একটা যেন নাই মনে হয়। মেয়েটি - কী? ভিকি - বাশি, মানে আমার গানের সুর তোলার আড় বাশিটি নেই আমার বাসায়। মেয়েটি - আমি বীনা, নাইস টু মিট ইউ। ভিকি কিছুটা হোচোট খেয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বীনার দিকে। বীনা - আপনার নাম জানতে পারি? ভিকি - আসলে আমি যে প্রফেশনে আছি এতে আমার নাম যদিও বলি আমি আপনাকে মিথ্যা বলবো। বীনা - কি করেন আপনি? ভিকি - কফিটা শেষ করেন, আমাদের এখুনি উঠতে হবে, আমি এক জায়গায় বেশি সময় থাকতে পারি না।
চার. (ডাঃ নাদির গবেষণাগার)
নাঈম (ফোনে)- ডন রেজো। মিশন সাকসেস। ডন রেজো - সুইসাইড নোটটা আমার হাতে পৌছায় দেও এন্ড ডেসট্রয় দ্য প্রজেক্ট। নাঈম - জ্বী। ডন রেজো - আর ওখানে দেখো সাবজেক্ট মাদার ও সাবজেক্ট বার্থ নামে দুইটা চেম্বার আছে। যারাই থাকুক ওর মধ্যে যাস্ট বার্ণ ইট। নাঈম - জ্বী।
পাচঁ. (ঘেরের পাড়ে)
ভিকি আর বীনা হাটতে হাটতে একটা ঘেরের পাড়ে এসে দেখে দুই আম গাছের মাঝে একটা বেঞ্চ বসানো। ভিকি - আমরা কি এখানে বসতে পারি? বীনা - এখানে কেনো, কোনো ভালো যায়গায় চলেন। ভিকি নিজ মনে টেনশন করতে করতে বীনাকে রেখে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো। দোকান থেকে বীনার জন্য দোকানের সব চকলেট ১০ টা করে নিলো আর নিজের জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিলো। ছোট ভাই শিহাব বলেছে, সিগারেট খেলে নাকি জড়তা কাটে!
ভিকি বীনার দিকে চকলেট গুলো এগিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিলো নিজে। বীনা - আপনি কি করেন বললেন না যে? ভিকি - আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি? বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো, মেয়েটি মুচকি হেসে ভিকির হাত ধরে হ্যান্ডশেক করলো।
ভিকি - জায়গাটা কেমন? বীনা - সুন্দর বাট এসি রুমের পরিবেশটা এই গরমে অনেক উপকারি। হঠাৎ এক দমকা বাতাসে সব গরম উবে গেলো। আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। ভিকি - কই চকলেট খান! বীনা - আপনার পরিচয়? ভিকি - জানলে পালাবেন না তো? বীনা - জীবনে সহযোগী পেয়েছি অনেক কিন্তু ফ্রেন্ড পাই নি। আপনিই আমার প্রথম ও শেষ ফ্রেন্ড। ভয় নেই আমি ফ্রেন্ডকে ছেড়ে পালাবো না। বলেই বীনা ভিকির সিগারেট টা নিয়ে টানা শুরু করলো। ভিকি চুপ। বীনা (মুচকি হেসে) - বন্ধুর সাথে সব ভাগাভাগি করা যায়, এটা যাবে না কেন? ভিকি (একদমে) - আমি একজন হ্যাকার।
সাময়িক সময়ের জন্য সব স্তব্দ হয়ে গেলো। গাছের পাতার সাথে ঘেরের পানি সমান তালে দুলে চলেছে। ভিকি - কি চুপ হয়ে গেলেন! বীনার উত্তর নেই একমনে সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। এরমধ্যে মেঘ গর্জন করে উঠলো। ভিকি - ভয় লাগে না? বীনা - ভয় কিসের? আমি জেনে গেছি আপনি খুব ভালো একটা মানুষ। আমি আপনার মতো ভালো নই, কিন্তু আমার সারা জীবনের সখ ছিলো একজন সত্যিকারের ফ্রেন্ড পাওয়া। আজ পেয়েছি।
ঝপঝপ করে বর্ষা শুরু হয়েছে। ভিকি বীনার হাত ধরে উঠে দাড়ায়ে বললো - চলো আজ তোমাকে দেখাবো ট্রু ফ্রেন্ডশিপ। বাইকের গতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ১০১,১০২,১০৩...১১৭ এমন সময় ভিকি চিৎকার দিয়ে বললো - হোয়াট ইজ ফ্রেন্ডশিপ? বীনা - বাইকের পিছ থেকে চিৎকার দিয়ে বললো - ফল ইন ডেস্পারেট উইথ বিলিভ। এবার দুইজনই একসাথে জোরে চিৎকার করে বাইক হাকিয়ে চললো বৃষ্টিভেজা পিচে।
ছয়. (ডাঃ নাদির সুইসাইড নোট)
আমি ডাঃ নাদি বলছি। আমার সারাটা জীবন উৎস্বর্গ করেছি জীবনের খোঁজে। আজ আমি সফল। কিন্তু প্রত্যেক সফলতার পিছে গ্লানি থাকে এক্ষেত্রে আমার গ্লানি অমার্জনীয়। হতে পারে জাকলিনা একজন পতিতা, তাই বলে তার কি বাচার অধিকার নেই। তাকেই কেনো গিনিপিগ করে ক্লোন তৈরি করতে হবে। তার মৃত্যুর সময় প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া আর তার নিথর দৃষ্টি আমাকে শিখিয়ে গেছে আমরা কতটা বর্বর। এজন্য জাকলিনের ক্লোন বীনাকে আমি মুক্ত করে দিলাম, ও বাচুক ওর মতো করে, আর আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চললাম বিধাতার সাথে সাক্ষাতে।
নাঈম ১ ঘন্টা চুপ করে রইলো সুইসাইড নোট পড়ে। চোখ থেকে বেয়ে চলেছে অশ্রু। এবার নাঈম হাসতে শুরু করলো আর পিস্তল লোড করতে করতে বললো - ডোন্ট ক্রাই বিকোজ ইটস ওভার, স্মাইল বিকোজ ইটস হ্যাপেন। বলেই অট্ট হাসিতে মেতে উঠলো নাঈম।
সাত. (এক মুহূর্ত)
সন্ধ্যা ৭ টায় ভিকির ফোনে রিং আসতেই কেটে দিলো ভিকি। কি হলো এসব? আমি যে মেয়ের সাথে দেখা করতে যাবো সে তো আজ আসেই নি, তার নাকি জ্বর! কি সব কথা। তাহলে সকালের মেয়েটি কে? একটু পায়চারি করে আবার ভাবতে শুরু করলো - যেই হোক, আমি আজ সত্যিই খুশি হে বিধাতা, তুমি আজ আমার মতোই এক বন্ধু যাকে আমি আমার মতো করে চাইতে পারবো, তাকেই মিলিয়ে দিয়েছো। আবার রিং। ভিকি বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে - কে ভাই? বীনা - আমি। ভিকি - জানি তুমিই। বীনা - আপনি তো জেনে গেছেন আমি আপনার অপেক্ষার সেই মেয়ে না। ভিকি - তুমি আমার চিরো অপেক্ষার একজন। বীনা - এই শোনো না। ভিকি - হুম। বীনা - যদি তোমার সাথে আর কোনোদিন দেখা না হয়? ভিকি - বাজে কথা রাখো আমি মোবাইলে টাকা লোড দিয়েই কল দিচ্ছি। বীনা - আচ্ছা শোনো তোমাকে একটা কথা বলব? ভিকি - শিওর। বীনা (কাদো কাদো সুরে) - আমি আজ তোমার সাথে যে টুকু সময় পার করেছি তা ছিলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া, সত্যিকারের ভালোবাসা আজ দেখেছি, আমি যেখানেই থাকি যেমনই থাকি কোনোদিন ভুলবো না তোমায়। ভিকি - তুমি শুধু আমার সাথে থাকো আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেবো। বীনা - বুঝলাম মি. হ্যাকার। আমি ফোন রাখছি, আমাকে রুটি বানাতে হবে। ভিকি - ওকে বাই এক ঘন্টা পরেই কল দিচ্ছি।
আট. (বিশ্বাস - অবিশ্বাস)
হন্তদন্ত হয়ে শিহাব ঢুকলো ভিকির রুমে। ভিকি - শিহাব আসছো, আমি কি যে টেনশনে আছি জানো না। বীনার কোনো হদিস পাচ্ছি না। কাল আমার সাথে শেষ কথা হয় সন্ধ্যা ৭ টায় এরপর থেকেই ফোনের সুইচ অফ। বুঝতেছি না কি করবো। শিহাব - ভাই, কিছুই করা লাগবে না। ও একটা পতিতা! সে আসছিলো তার খোঁজে আর হতভাগা আপনি গেছিলেন ভালোবাসার খোজে। বলেই শিহাব কেদে ফেললো। ভিকি চুপ। শিহাব আবার শুরু করলো - তারে কাল রাতে কারা যেন নিয়ে গেছে, যাহ শালা বেয়াদব নরকে যা। ভিকি (কাপা কন্ঠে) - কবে আসবে? শিহাব - কি জানি, সেই জানে। চলেন ভাই বাইরে চলেন, আপনি তো টেনশনে শেষ হয়ে গেছেন। আপনি এতো বড়ো হ্যাকার আর আপনি ধরতে পারলেন নাহ। ভিকি কিছু না বলে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। শিহাব পিছে বের হবার সময় কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখলো সাদা আর কালো রঙের মাঝে ফ্রেন্ডশিপ দিয়ে এক সাঁকো তৈরি করা।
সী বিচে বসে আছে ডন রেজো। ম্যাসেজ আসলো নাঈমের কাছ থেকে - মিশন সাকসেস। সাবজেক্ট বার্থ বীনা ইজ নো মোর। ডন রেজো ফোন করে অন্য একজন কে জানালো - ফিনিশ নাঈম। এবার গ্লাস হাতে নিয়ে বললো - ট্রাস্ট ইজ এ ডেঞ্জারাস গেইম! চিয়ারস।
নয়.
আকাশ মেঘলা হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শো শো করে বাতাস বইছে ঘেরের পাড়ে। ভিকি চুপ করে বসে আছে। ভিকির চিন্তায় শুধু গতকাল এর সব স্মৃতি, হঠাৎ ভিকি চিৎকার দিয়ে - এই মেয়ে, এই মেয়ে, এই মেয়ে, তোরে আমি, আমি চাইছি, তুই আমারে চিনোস নাই, তুই যদি বিধাতার কাছেও যাইস তোরে আমি ঠিকই নিয়ে আসবো।
No comments:
Post a Comment