হেলমেট ৭ – (নিঃসঙ্গ গ্রহে এক প্রতীক্ষিত বর্ষাকে বরণ)
মোঃ খালিদ বিন মাসুদ
(এই গল্পটি খুলনা কালচারাল সেন্টার এর ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।)
এক
এক ফোঁটা জল চোখের পাতায় পড়ায়, চোখ মেলে তাকালো দিথী। আকাশের দিকে চেয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেলমেট ৭ কে প্রশ্ন করলো – কি মনে হচ্ছে? বর্ষা কি আসছে? হেলমেট ৭ – আসবে। হেলমেট ৭ এর উত্তর শুনে ও অবাক হয়। ভাবতে থাকে হেলমেট ৭ কেনো বলল না যে আজ বাতাসের গতি বেশি বা বাষ্পের পরিমান কম। আরো ভেবে অবাক হয় আমি কতটা অসহায়, আজ যন্ত্র আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে! দিথী আবার চোখ বন্ধ করে কিন্তু সাথে সাথেই চোখ মেলে এবং বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। হেলমেট ৭ প্রশ্ন করে – আজো কি একই স্বপ্ন দেখলে? দিথী কাপা কাপা গলায় বলে – আমি কেন প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখি? হেলমেট ৭ – হয়তো তুমি মানুষ না, আমার মতো রোবট। দিথী তখন নিজের পেটের দিকে তাকায়। দেখে তার সন্তানেরা পেটের মধ্যে নড়াচড়া করছে। সে মনে মনে বলে – রোবট হলে কি আর সন্তান জন্ম দিতাম? দিথী, হেলমেট ৭ কে উদ্দেশ্য করে বলে – আচ্ছা তোর কি মনে আছে ঐ রাতে কি হয়েছিল? হেলমেট ৭ কোনো উত্তর দিল না। দিথী – তুই মিথ্যা বলাও শিখে যাচ্ছিস? হেলমেট ৭ – দ্বিতীয় চাঁদ উঠে গেছে। খাবার জোগাড় করতে যাচ্ছি। সাবধানে থেকো। দিথী বুঝলো হেলমেট ৭ তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই সে আর কোনো কথা বাড়ালো না। ঘুণে খাওয়া একটা লাঠি নিয়ে বলল – যা, আমি ঠিক আছি। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।হেলমেট ৭ গেছে অনেক সময় হয়েছে। সবুজ আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে দিথী। এই গ্রহে দ্বিতীয় চাঁদ ওঠার সাথে সাথেই আকাশের রঙ নীল থকে সবুজ হয়ে যায়। অর্ধেক ওঠা এই চাঁদের দিকে চেয়ে ও ভাবতে চেষ্টা করে সেদিন রাতে কি হয়েছিল?
রাতের ঘটনা – সবাই ছুটছে। ক্ষিপ্র ১৭ এ আগুন লেগেছে। দিথী খুজছে ইয়ানকে। ইয়ান ক্ষিপ্র ১৭ এর পেলোড কমান্ডার। ও পেটে বাচ্চা নিয়ে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের অনেক জিনিসে আগুন লেগে গেছে। খুব সাবধানে পার হচ্ছে। এমন সময় দূর থেকে দেখতে পেলো ইয়ানকে। দিথী চিৎকার করে ডাকল। ইয়ান ফিরে তাকাল। এতো কঠিন বিপদেও মুচকি হেসে হাত বাড়াল ওর দিকে। দিথী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুহূর্তেই সামনে একটি বিস্ফোরণ ঘটলো। দিথীর চোখে সব ঝাপসা দেখছে। কে যেন ওকে হিউম্যান লঞ্চ টিউবে তুলে দিল। উফফ আর পারছি না – বলে চিৎকার করে উঠল দিথী। তার নিজের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার নিজের কানেই ফিরে এলো। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে তার গর্ভের সন্তানদের উপর হাত রেখে মমতার স্বরে বলে – মনে আছে, তোদের বাবা তোদের জন্য কি নাম রেখেছিল? একজন আলিয়ান, আর একজন আলিয়া। যমজ সন্তানেরা নড়ে উঠে। দিথী মুচকি হেসে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ বজ্রের শব্দে দিথীর ঘুম ভেঙে যায়। দিথী কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠে। এই গ্রহে বসবাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোনো দিন সে এতো প্রকট বজ্রের শব্দ শোনেনি। আসলে এখানে ঝড়-বর্ষা হয় কিনা তাও সে জানে না। ও মনে মনে বলতে থাকে – হেলমেট ৭ এখনো এলো না কেন? এর মধ্যে বাতাস ছেড়ে দিয়েছে। দিথী অনেক কষ্টে তাদের তাবুটা ঠেকাতে লাগলো।
হেলমেট ৭ ফিরে এসেছে। দিথী পাখির ডিম আর মাংস পুড়িয়ে খাচ্ছে। খেতে খেতে বলল – রাতে ঘুমাবো কোথায়? বহু চেষ্টা করেও তো আর শেষ রক্ষা হলো না। তাঁবুটা তো নিয়েই গেলো বাতাসে। হেলমেট ৭ – রাতে খোলা মাঠে থাকা যাবে না। দিথী – তাহুলে কোথায় যাবো? জঙ্গলে? হেলমেট ৭ – হ্যাঁ। দিথী – বিপদের সম্ভাবনা কতটা? হেলমেট ৭ – জঙ্গলে পাখি আর বিষাক্ত সাপ ছাড়া আর কিছুই নেই। দিথী – কি? বিষাক্ত সাপ? উফফ আমার সাথেই কেন এমন হয়? বর্ষাও হলো না, শেষ রক্ষাটাও চলে গেল। আর এখন সাপের সাথে থাকতে হবে। হেলমেট ৭ কিছু না বলেই চলতে শুরু করলো। দিথীও অসহায়ের মতো তাকে অনুসরণ করতে থাকলো।
হেলমেট ৭ বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে নভোচারীদের প্রতিরক্ষায়। এরা স্বয়ংক্রিয় ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মানুষের সাথে সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রোগ্রাম করা। এরা মানুষের অনুভূতি বুঝে সে অনুযায়ী সাড়া প্রদান করে। এমনকি নিজের ধ্বংস থেকেও মানুষের যত্নে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। হেলমেট ৭ দেখতে অনেকটা ফোলা বেলুনের মতো। তবে প্রয়োজনে এরা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারে। এরা সোলার সেলের মাধ্যমে নিজেই নিজের জ্বালানি তৈরি করে।
জঙ্গলে হেলমেট ৭ কাজ করে চলেছে তাবু তৈরিতে। দিথী ভাবছে এই আজব যন্ত্রটা কে দিল তার সাথে? সে যখন ক্ষিপ্র ১৭ থেকে লঞ্চ করেছিল তখন একা ছিল। তবে এটা কি এই গ্রহের? এটা কি এলিয়েন? ও চিন্তা করতে থাকে এদের তো কোনো দিন ক্ষিপ্র ১৭ এ দেখি নাই। এর নাম যে হেলমেট ৭ তা সে নিজেই বলেছে। নাহ আর চিন্তা করতে পারবো না – দিথী বলে উঠলো। হেলমেট ৭ – আজ রাতের ব্যবস্থা মোটামুটি করেছি। এখন বিশ্রাম করো। দিথী এসব আর ভাবতে চায় না। সে এবার আরাম করে বসে সবুজ আকাশের দিকে চেয়ে ভাবতে চেষ্টা করে ইয়ানের সাথে কিছু মুহূর্তের কথা।
দুই
কেবিন ১১; ইয়ান তুমি এতো কিসের চিন্তায় থাকো – বিরক্তির স্বরে বলল দিথী। ইয়ান – কেবিন ৯ ও ১০ নিয়ে খুব চিন্তিত। দিথী – হ্যাঁ তুমি তো পেলোড কমান্ডার। সবার চিন্তা তো তোমার করাই লাগে। ইয়ান – আরে না। এমন না। দিথী – তাহলে কেমন? ইয়ান – আসলে কেবিন ৯ ও ১০ এর ক্রু ক্ষিপ্র ১৭ নিয়ে হয়তো কোনো ষড়যন্ত্র করছে। দিথী – তোমরা সবাই একি স্পেস শিপে আছো। এখানে আবার ষড়যন্ত্রের কি আছে? হঠাৎ কন্ট্রোল রুম থেকে ফোন আসলো। ইয়ান চলে যাচ্ছে এমন সময় দিথী তার গর্ভের দিকে চেয়ে বলল – দেখ আমাদের সন্তানেরা কেমন দুষ্টুমি করছে। ইয়ান ফিরে এসে বলল – অরা আমাদের সন্তান। ওরা নিশ্চয়ই এই গ্রহাণুপুঞ্জে স্থান করে নেবে। দিথী এ কথার কোনো অর্থ খুজে পেলো না। সে ইয়ানের দিকে এক পলকে তাকিয়ে রইল, আর ইয়ান কেবিন ১১ থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল।
আচমকা বজ্রের শব্দে দিথীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। হেলমেট ৭ – তড়কা বান আসছে। এখুনি পালাতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে অল্প বৃষ্টিতে ঢাল বেয়ে পানির স্রোত বয়ে যায়, একেই তড়কা বান বলে। হেলমেট ৭ ও দিথী দ্রুত করে ঢালের উপর উঠে এলো। ঢালের উপর আসতেই একদল ইলেকট্রিক পতঙ্গের কবলে পড়লো ওরা। হেলমেট ৭, দিথীর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো। ইলেকট্রিক পতঙ্গদের শকে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো হেলমেট ৭। হেলমেট ৭ – পালাও। দিথী পালাচ্ছে আর পিছু ফিরছে। পিছে হেলমেট ৭ এক রোবট হয়েও মানুষকে বাঁচানোর এমন আবেগ দেখে চোখে জল আসতে লাগলো। কিন্তু তাকে সাহায্যের কোনো চেষ্টা না করেই ছুটে চলল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ সে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
ঝাপসা পথ। আলোক স্বল্পতায় পথ চেনা দায়। দিথী একটা মশাল নিয়ে হেটে চলেছে। চারিদিক থেকে পশু পাখির ডাকার আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নিজের পায়ের শব্দই যেন নিজের কাছে অপরিচিত মনে হয়। হিমশীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সবই যেন কল্পনা মনে হচ্ছে। এই ভয়ংকর পরিবেশে দূরে অস্পষ্টভাবে কাউকে দেখা গেল। এমন সময় কানের ধারে ফিস ফিস করে হেলমেট ৭ বলল – যাকে দেখছ ও আমাদের বন্ধু না, শত্রু। দিথী আরো ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। দেখে চিৎকার দিয়ে বলল – আরে এ তো ইয়ান! হেলমেট ৭ – হ্যাঁ ও ইয়ান। কিন্তু ও আমাদের শত্রু। দিথী আর কিছু ভাবতে পারছে না। ইয়ান তার স্বামী, বন্ধু, ভালোবাসা। কিন্তু হেলমেট ৭ ইয়ান কে নিয়ে এমন কথা কেন বলছে? এমন সময় অনুভব হল তার পুরা শরীর যেন কিসে ঝাকাচ্ছে।
ঘোর থেকে চেতনা এল দিথীর। দেখলো হেলমেট ৭ ই ওকে ঝাকাচ্ছিল। দিথী – ঝাকাচ্ছিলি কেন? কত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। হেলমেট ৭ (থেমে থেমে)- বর্ষা আসছে। আর ১ কিলোমিটার। দিথী উঠে বসলো। চোখ মুছে বড় বড় চেয়ে দেখে বিশাল মেঘ ধেয়ে আসছে। ও আনন্দিত হয়। দিথী (অবাক হয়ে) – তোর এ কি অবস্থা হয়েছে? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তুই কেন শেষ হয়ে গেলি? হেলমেট ৭- বর্ষার সাথে কিছু একটা আসছে। দিথী – কি? হেলমেট ৭ – এক মানুষ, বর্ষার আগে দৌড়িয়ে আসছে। ও আমাদের শত্রু। আমার ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ওকে প্রতিহত করতে পারবো না। হেলেমেট ৭ কে থামিয়ে দিথী আনমনে বলল – থাক না। যে আসে আসুক। শুধু বর্ষাকে বরণ করো।
এক একটা করে ফোঁটা এসে পড়ছে, আর দিথী চোখ বুজে তা অনুভব করার চেষ্টা করছে। কখন বর্ষা এসে তাকে সিক্ত করবে এখন কেবল তারই প্রতীক্ষা। বৃষ্টির সাথে আর কি ধেয়ে আসছে তা নিয়ে ওর বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথ্যা নেই। এদিকে হেলমেট ৭ শাট ডাউন হতে চলেছে। সেদিকেও খেয়াল নেই তার। দিথী শুধু চায় এখন এক পশলা বৃষ্টি, যার প্রতীক্ষায় দিন গুনছে সে। অবশেষে বর্ষা এলো। বর্ষা তাকে ভিজিয়ে, দিলো এক তৃপ্তির স্বাদ। সেই সাথে এনে দিলো এক চেনা মানুষের হাত।
দিথী (চোখ বুজে)- ইয়ান তুমি? ইয়ান – হ্যাঁ আমি। দিথী- একি সত্যিই তুমি? ইয়ান- হ্যাঁ আমি। তোমার আমি। আমি এসেছি শুধু তোমায় ভালবাসতে। দিথী অবাক হলো। ইয়ান ছিলো যন্ত্র নয় অথচ যন্ত্রের মতো এক মানুষ। আজ সে এতো রোম্যান্টিক কেন? তবু সে চিন্তার থেকে স্বস্তিতেই বেশি। আজ সে মহা খুশি। কেননা আজ বর্ষা আর জীবনকে সে এক সাথে পেয়েছে। স্রস্টা তার সব ইচ্ছা পূরণ করায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু বর্ষার ছোঁয়ায় তা ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে রঙধনু সেজেছে। হেলমেট ৭ ইতিমধ্যে নিস্তেজ হয়ে গেছে। এক পলক মেলে ইয়ানের দিকে তাকিয়ে দিথী বলল - কিন্তু হেলমেট ৭ তোমাকে শত্রু কেন ভাবল? ইয়ান (অট্ট হাসি দিয়ে) - কারণ হেলমেট ৭ গল্পের মাঝের অংশটাই জানে।
ইয়ানের হাসির অর্থ দিথীর অজানা।
এরকম আরো সায়েন্স ফিকশন গল্প পড়তে Science Fiction লিংকে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment